দুনিয়া যার কাছে খোলা আঙিনার মতো, তিনি কাজী আসমা আজমেরী। তার আছে জাদুর মতো শক্তি। আর আছে স্বপ্নের সাগর। স্বপ্ন ভাসিয়ে দুনিয়াকে বশ মানিয়েছেন এই নারী। এখন পর্যন্ত পা রেখেছেন ১১৫টি দেশে।
কিভাবে সম্ভব!
একে তো তিনি নারী! তার ওপর সবুজ পাসপোর্টধারী! দুটোই দুনিয়া ভ্রমণের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সব দেয়াল টপকাতে পেরেছেন বলেই কাজী আসমা আজমেরীকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সমাজ আর বাস্তবতার দেয়াল টপকানো খুব সহজ নয়। আবার হৃদয় থেকে চাইলে খুব কঠিনও নয়। আজমেরীর বেলায় কঠিন ছিল না। কারণ তার চোখ খুলে গিয়েছিল। খোলা চোখে দুনিয়াকে দেখেছেন। আর পায়ের ছাপও রেখে এসেছেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতা বলছে, এমনটি অসম্ভব!
হ্যাঁ, আসমাকেও একই কথা জানিয়েছিলেন তার এক বন্ধুর মা।
সময়টা ছিল আজ থেকে ১২ বছর আগের। তখন আসমার চোখ অন্য আট-দশজনের মতোই ছিল। সবাই যা দেখতে পেত, তিনিও তাই দেখতেন। তবে সবাই যেমন করে ভাবতেন। তিনি ভাবতেন একটু অন্য রকম করে।
আসমার জেদ ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। আর ছিল দারুণ চঞ্চলতা। তবে ও দুটোর কোনোটাই ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। বাবা কাজী গোলাম কিবরিয়া প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা কাজী শাহিদা আহমেদ বনেদি পরিবার থেকে এসেছেন। তাদের প্রথম সন্তান আসমা। আছে ছোট এক ভাই।
বাবা-মা আর দুই সন্তানের পরিপাটি পরিবার। আসমার জীবনের শুরুটা খুব রকম পরিপাটিই ছিল। খুলনায় পরিবারের সাথে থেকেই স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন। খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ, ইস্টওয়েস্ট থেকে এমবিএ শেষ করেন।
কেতাবি শিক্ষা আর পারিবারিক ইতিহাস দেখলে আসমার একজন ব্যবসায়ী হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি হলেন ট্র্যাভেলার।
কেন?
তার চোখ খুলে গিয়েছিল বলেই বিশ্বকে বাড়ির আঙিনার মতো করে দেখতে পেয়েছিলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন।
২০০৭ সালে থাইল্যান্ড যান আসমা। ওটা ছিল গতানুগতিক ভ্রমণ, অন্য আট-দশজন যেমন করে যান। তখনো মাথায় দুনিয়া চষে বেড়ানোর চিন্তা আসেনি তার।
এক দিন শুনলেন তার এক বন্ধু ২৭টি দেশ ঘুরে এসেছেন। সেই বন্ধুকে দেখতে অনেকেই ভিড় করল। আসমাও গেলেন। ভ্রমণফেরত বন্ধুর দেখা পেয়ে তিনিও ভাসলেন আবেগে। বললেন, ‘পৃথিবী দেখতে আমিও যাবো’। কথাটা শুনলেন ওই বন্ধুর মা। তিনি আসমাকে অনেকটা কটু ভাষায় জানিয়ে দিলেন, একজন নারীর পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
জেদি মেয়ে আসমা। কথাটা সহজভাবে নিতে পারলেন না। জেদ চেপে রাখলেন, এক দিন পৃথিবী দেখতে যাবেন-ই। কিন্তু চেপে রাখা এসব জেদ বেশি দিন লালন করা যায় না। অন্য বাস্তবতার সাথে বাতাসেই মিলিয়ে যায়। আসমার বেলায়ও তাই হলো।
তা হলে তিনি কী করে ট্র্যাভেলার হয়ে উঠলেন?
এবার জানুন কাজী আসমা আজমেরীর থেকেই, ‘নেপাল বেড়াতে গিয়ে আমার চিন্তাটা পাল্টে গেল। তখন ২০০৯ সাল। আমার শরীর ও মন খারাপ ছিল। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন হাওয়া বদল করার। হাওয়া বদলাতে অনেকে নেপালকেই বেছে নেয়। আমিও তা-ই নিলাম।’
তার পর?
আজমেরী বললেন, ‘হাওয়া বদলাতে গিয়ে নিজেই বদলে গেলাম। ঘটনাটা ঘটে যায় এক ঘণ্টার মধ্যে। কাঠমান্ডু থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া করে এভারেস্ট দেখতে গেলাম। হিমালয়ের মাথার ওপর যখন কপ্টার উড়ছিল, আমার মনে হলো কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসেছি। এত দিন আটকে ছিলাম। বদ্ধ ছিলাম সামাজিক দেয়ালে। অথচ পৃথিবী বসে আছে আমার জন্য, খোলা আঙিনা নিয়ে। অনেক অনেক অজানা নিয়ে। তখন পৃথিবীকে দেখার প্রবল ইচ্ছা হলো। হিমালয়ের মাথার ওপর কপ্টারে চক্কর দিতে দিতেই সিদ্ধান্ত নিই আমি পৃথিবী দেখব।’
নেপাল থেকে ফিরে এসে নিজের গয়না বিক্রি করে দিলেন কাজী আসমা আজমেরী। ওই টাকা দিয়ে বেরিয়ে যান খোলা আঙিনায়। সেই যে শুরু, এখনো চলছে।
এখন তিনি আছেন নিউজিল্যান্ডে। এক শ’ ছাড়িয়ে আরো ১৫টি দেশের মাটি ছুঁয়ে আসা এই নারী ওই দেশে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। কাজের বিরতিতে বাংলাদেশেও আসেন। আবার কাজে ফিরে যান। এবং ছোট্ট কচ্ছপের মতো পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে যান দুনিয়ার আঙিনায়।
আজমেরীর এই কচ্ছপযাত্রা মোটেও প্রমোদ ভ্রমণ নয়। অনেকটাই দুঃসাহসিক। তিনি এক্সট্রিম ট্র্যাভেলার। কেবল প্রকৃতির সুন্দর নয়, তিনি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান মানুষের সুন্দরকেও। ঢুকে যান মানুষের কৃষ্টির ভেতর। ডুব দিয়ে আসেন সংস্কৃতি আর ইতিহাস থেকে।
ওই সবের সাথে নীল রঙের সাগর আর একটু গরম হাওয়া। আসমার হৃদয়ে ঢেউ তুলতে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না।
আর তিনি যেটা চান, দেশের মানুষের ভালোবাসা। কারণ তিনি দেশকে ভালোবাসেন। এত বছর নিউজিল্যান্ডে থেকেও ওই দেশের পাসপোর্ট নেননি। তিনি কেবল সবুজ পাসপোর্টের মালিক হয়েই থাকতে চান।
আসমার এই জেদের পেছনেও আছে আরেক গল্প। জানুন তার থেকেই, ‘তখন ২০১০ সাল। আমি গিয়েছিলাম ভিয়েতনামে। দিনটা মনে আছে ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ। ওই দিন সাড়ে ছয় ঘণ্টা আমাকে ইমিগ্রেশনে আটকে রাখা হয়েছিল কেবল বাংলাদেশী পাসপোর্টের কারণে।’
বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকলে সাড়ে ছয় ঘণ্টা আটকে থাকতে হবে কেন?
‘কারণ অনেক দেশ সবুজ পাসপোর্টকে বিশ্বাস করতে পারে না। অনেকেই বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে গিয়ে ওই দেশে থেকে যায়। তাই কিছু কিছু দেশে সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই সন্দেহ করা হয়।’
কাজী আসমা আজমেরী বললেন, ভিয়তেনামে তার সাথে যা ঘটেছিল, ‘ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে ২৩ ঘণ্টা কারাগারে আটকে রেখেছিল। তখন মনে অনেক ক্ষোভ জন্মেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাতে। ওদের অজুহাত ছিল আমি রিটার্ন টিকিট করিনি। হোটেল বুক করিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।’
সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে আরো কোনো বাধার মুখোমুখি হয়েছেন?
‘হ্যাঁ, বরাবরই হতে হয়। কিন্তু আমার জেদের কাছে ওসব বাধা টিকতে পারে না। ভিয়েতনামের ঘটনার পর ওই বছরই আমি গিয়েছিলাম সাইপ্রাস। দেশটিতে বাংলাদেশীদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা আছে। কিন্তু তার পরও ছাড় পাইনি। আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার হোটেল বুকিং, রিটার্ন টিকিট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট নিতে ভুল করিনি। কিন্তু ওসব থাকার পরও সবুজ পাসপোর্ট দেখে আমাকে সন্দেহ করা হয়। সাইপ্রাসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়। খাঁচার ভেতর ২৭ ঘণ্টার ওই লজ্জা কখনো ভুলতে পারব না। অপমানে আমি প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়েই বিশ্ব ভ্রমণ করব। দেখিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশীরা কাজ করতে যেমন অন্য দেশে যায়। তেমনভাবে ভ্রমণ করতেও যায়।’
সবুজ পাসপোর্টের এই জটিলতা কিভাবে দূর করা সম্ভব?
‘এর জন্য আমি কাজ করছি। চেষ্টা করছি বাংলাদেশের সবুজ রঙের পাসপোর্টের মানোন্নয়নে সহায়তা করতে। যারা অবৈধভাবে বিদেশ যান, তাদেরকে নিরুৎসাহিত করছি। সচেতন করছি। ভ্রমণ করতে গিয়ে থেকে যাওয়ার প্রবণতা দূর করতে বলছি। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণে মানুষকে উৎসাহিত করছি।’
কাজী আসমা আজমেরী চান তার মতো করেই বাংলাদেশী আরো তরুণের সামনে খুলে যাক পৃথিবীর দরজা। এই দরজা সহজে খুলতে হলে চাই যুৎসই চাবি। আর এই চাবির কারিগরদের একজন তিনি নিজেকে মনে করেন। কেবল আসমাই নন, এই মনে করাটা গোটা দেশবাসীর। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বও এখন তাকে জানে।