মওলানা ভাসানীর চীন সফর : অন্যবদ্য এক স্মৃতিচারণ

Date:

Share post:

বাংলাদেশের ইতিহাস আর মওলানা ভাসানী জীবন-প্রবাহ একই গতিতে চলেছে। নানামুখী ছিল মওলানার জীবন। এক শতাব্দী বিস্তৃত মওলানার বিশাল বিপুল সংগ্রামবিক্ষুব্ধ জীবনের প্রতিটি বাঁকই বর্তমান প্রজন্মের জানা দরকার। আবার মওলানা কেবল রাজনীতিবিদই ছিলেন না। তিনি দক্ষ লেখকও ছিলেন। নতুন কিছু জানার আগ্রহ তার মধ্যে ছিল অপরিসীম। আর তা ভালোভাবে ফুটে ওঠেছে তার মাও সে-তুঙ-এর দেশে নামের বইতে। মাও সে-তুঙের নেতৃত্বে চীনের নতুন যাত্রার সময়কালেই চীন সফর করেছিলেন। সফরকালে তিনি নতুন চীন সম্পর্কে এমন অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেছিলেন, যেগুলো সাধারণত লোকজন এড়িয়ে যেতে চায়।

তবে মওলানা কেবল চীনই নয় আরো কয়েকটি দেশ সফর করেছিলেন। তার এসব সফর আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক একটি উজ্জ্বল অধ্যায় যুক্ত করেছে। ১৯৫৪ সালের ইউরোপ ভ্রমণ, ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে চীন, কিউবা ও জাপান সফর, ১৯৫৮ সালে মিসর সফর তাকে মাও সে-তুং, চৌ এন লাই, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, জামাল আবদুল নাসের, আহমদ সুকর্ন, নক্রমা, নেহেরুর মতো ওই সময়ের সেরা বিশ্ব নেতাদের সংস্পর্শ এনে দেয়। এর মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমিরকার মজলুম জনতার অবিসংবাদিত মহানায়ক। আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, সৌদি আরব সফর করার সময় তিনি বাদশাহ আবদুল আজিজকে বাদশাহী ত্যাগ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

মওলানার চীন সফরের সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রামাণ্য দলিল তার মাও সে-তুঙ-এর দেশে। এটি মওলানার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থী। চীনের অতীত ইতিহাসসহ বর্তমান রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যে গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছলেন, যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, তারই শাব্দিক নির্যাস ওঠে এসেছে এই গ্রন্থে।

বইটির ভূমিকাতেই তিনি বলেছেন, ‘আমার চীন সফরে আমার অনেক বন্ধুই দুঃখ পাইয়াছেন। অনেকে চীনের বদলে যদি আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাইতাম তবে খুশী হইতেন। চীনের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিলে আমার গলায় মালা পড়াইতে পারিতেন, এমন বন্ধুও আমার আছে। তাঁহাদের প্রায় সকলের মনের ভাই আমার জানা ছিলো। তবু আমি চীনে গিয়াছিলাম।’

তিনি বলেন, আজিকার সংঘাতক্ষুব্ধ বিশ্বে চীন এক মহাবিস্ময়। চীন আজ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লুণ্ঠিতজনসমষ্ঠির মুক্তি-সংগ্রামের নেতা। চীন এই তিনি মহাদেশের সদ্যেত্থিত জনগণের মুক্তিতীর্থ, আমি সেই তীর্থ দর্শনে গিয়াছিলাম। আমার সেই তীর্থদর্শন ব্যর্থ হয় নাই। নূতন জীবনবোধের প্রত্যয়-দীপ্ত আলোকে আমার আশী বছরের বিশৃঙ্খল জীবনকে নূতন করিয়া দেখিতে শিখিয়াছি, আর তাই আমার মনে কোন গ্লানী নাই; এখনও যাঁহারা কুৎসা রটনা করিতেছে একদিন তাহাদের ভুল ভাঙ্গিবে।’

“চীন দুনিয়ার বঞ্চিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের সব চাইতে দৃঢ় সব চাইতে আপনার বন্ধু। চীন তাই সাম্রাজ্যবাদের সব চাইতে বড় শত্রু। চীনকে, চীনের মানুষের সংগ্রামকে নির্মূল করিবার চক্রান্ত চতুর্দিকে। আমাদের দেশও সেই চক্রান্তের অংশীদার ছিলো। চীন-বিরোধী চক্রান্তকে যেখানে যে-ভাবে যতটুকু সম্ভব প্রতিহত করা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ১৯০ কোটি মানুষের পবিত্র কর্তব্য।”

“আমার সফর অভিজ্ঞতা স্বদেশবাসীকে সেই আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হেইতে যদি সামান্যতম সাহায্য করিতে সক্ষম হয়, তবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করিব।”

পিকিং-যাত্রার শুরুতে ঢাকা থেকে করাচী পৌঁছে মওলানা ভাসানী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একসময় সফর বাতিল হবার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতেতে চীন সরকার “ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে এমন একটি বিশেষ বিমানে লোকনায়ককে রেঙ্গুন থেকে তাদের দেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন।”

তিনি লিখেছেন, “আমরা যখন পিকিং পৌঁছিলাম তখন অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় ঘরের বাইরে রেরুনো কষ্টদায়ক। কিন্তু সেই বৃষ্টি আর শীতের হাওয়া উপেক্ষা করেও বিমানবন্দরে কয়েক হাজার লোক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। চীন সরকারের সহকারী প্রধানমন্ত্রী মার্শাল চেন-ই এবং সরকার ও কমিউনিষ্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।”