সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুরের নিভৃত পল্লির বলদীপাড়া-হলদীঘর খেলার মাঠ। দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মাঠই শিশুদের একমাত্র ভরসা। এখানে ফুটবল অনুশীলন করে অনেকের জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত খেলার সুযোগ হয়েছে। সেই মাঠেই আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে চায় উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন এলাকাবাসী।
সব দাবি উপেক্ষা করে গত রোববার প্রকল্পের মাটি ভরাট করতে গেলে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। এ সময় প্রশাসনের লোকজন স্থানীয়দের ওপর হামলা করলে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীসহ আহত হন ছয়জন। পরে আত্মরক্ষায় গ্রামবাসীও ইট নিক্ষেপ করলে আহত হন সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
এর জেরেই পুরো গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে পুলিশ। পুরুষদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাতজন নারীকে। বাদ যাননি তিন বছরের এক শিশুর মাও। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ২১ বিশিষ্টজন। তাঁরা মামলা প্রত্যাহার ও মাঠ খেলার জন্য ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
গত রোববার রাতে শাহজাদপুর থানায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পক্ষে মামলাটি করেন উপজেলা ভূমি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর-কাম-মুদ্রাক্ষরিক আবদুল হাই শেখ। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই গ্রেপ্তার এড়াতে সটকে পড়েন পুরুষরা। মামলায় বেআইনিভাবে সরকারি কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর, পরিদর্শনরত এসিল্যান্ড লিয়াকত সালমানকে হত্যার উদ্দেশে মারধরসহ ১০টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পুরুষদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আবদুল মজিদের স্ত্রী সেলিনা খাতুন, আল মামুনের স্ত্রী ঝরনা খাতুন, হুমায়ুন ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা খাতুন, আনসার আলীর স্ত্রী মালেকা বেগম, জামাল প্রামাণিকের স্ত্রী আকলিমা খাতুন, হুমায়নের স্ত্রী ওযুফা, আবদুল আলিমের স্ত্রী সুফিয়া খাতুনসহ সাত নারীকে। তাঁদের থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে পরিদর্শক (অপারেশন্স) আবদুল মজিদ গতকাল সোমবার সমকালকে জানিয়েছেন।
গ্রেপ্তার নারীরা বলেন, গ্রামের ঐতিহ্য খেলার মাঠটি রক্ষায় গণদাবি উপেক্ষা করে গ্রামবাসীকে আসামি করে মামলা হয়েছে। বিক্ষোভের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় উভয়পক্ষের লোক আহত হয়েছে। তবে মামলা হয়েছে একপক্ষীয়। গ্রামের মানুষ নিরীহ-অসহায়। তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা অমানবিক।
গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ মতুর্জ আলী ও আবু হোসেন জানান, পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচতে পুরুষরা রাতে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। এতে টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন নারীরা। গ্রেপ্তার ওজুফা নামে এক নারীর তিন বছরের মেয়ে আছে। সেই শিশু মরিয়মকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রতিবেশীরা। মেয়েটির বাবা বাড়িতে আসতে পারছেন না, মা হাজতে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে স্থানীয় দোকানগুলোও বন্ধ আছে। এ অবস্থায় ওই শিশু কান্নাকাটি করছে।
শাহজাদপুর থানার ওসি নজরুল ইসলাম মৃধা বলেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা সবাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। তবে তদন্তে প্রকৃত অভিযুক্তরা শনাক্ত হবেন।
শাহজাদপুরের সন্তান বিকেএসপির নিয়মিত মহিলা ক্রিকেটার নয়নতারা বলেন, শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী এই খেলার মাঠে জড়িয়ে আছে আমাদের বাপ-দাদাদের স্মৃতি। জড়িয়ে আছে আমাদের শৈশবের রঙিন সময়। এই মাঠ থেকে দেশের অনেক গুণী খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। অথচ এই খেলার মাঠ দখল করে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনোক্রমেই এই মাঠ দখল করে অন্য কিছু করতে দেওয়া হবে না।
২১ বিশিষ্টজনের বিবৃতি
বলদীপাড়া-হলদীঘর গ্রামে মাঠ নিয়ে গ্রামবাসীর ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ২১ বিশিষ্ট নাগরিক। সোমবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, আশ্রয়ণ প্রকল্প বর্তমান সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে খেলার মাঠে প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতিদাতারা প্রশাসনের উপস্থিতিতে সহিংসতা, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, হামলার ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তার নারীদের মুক্তিরও দাবি করা হয়।
বিবৃতিদাতারা হলেন- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ব্লাস্টের অনারারি ডিরেক্টর সারা হোসেন, উন্নয়নকর্মী নবনীতা চৌধুরী ও বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।